শুক্রবার

#নিয়তি( পর্ব--৮) । একটি ইসলামিক গল্প

#নিয়তি( পর্ব--৮)
একটি ইসলামিক গল্প

নাবা ইমাদের প্রশ্নে  নাজিফার দিকে তাকালে নাজিফা নাবাকে ইশারা দিয়ে  চুপ থাকতে বলে। 
ইমাদ আবারো নাবাকে জিজ্ঞাসা করে --- বলো তুমি কী বলতে চেয়েছো????

--- না কিদুনা।

এই বলে নাবা এক দৌড়ে রুম থেকে চলে গেলে, নাজিফা জোরে একটা শ্বাস ফেলে বললো ------ বাঁচা গেল।
ইমাদ তা দেখে বলে--- কোনো কিছু তো আপনি আমার থেকে গোপন রাখতে চাচ্ছেন। 
--- কী গোপন করবো,  ইয়ে মানে এসব না বলে আপনি এতোক্ষন কোথায় ছিলেন সেটা বলুন?

--- সেটা যেনে আপনি কী করবেন?

এনিওয়ে আমি নিচে যাচ্ছি। 
ইমাদ নিচে নামতেই দেখে চারপাশে নিশ্চুপ কোনো সাড়া শব্দ নেই।রান্না ঘরে ও কেউ নেই, কদম, বুয়া,মা কাউকে কোথা ও দেখা যাচ্ছেনা।  ইমাদ আশ্চর্য হয়ে সালেহার ঘরে গিয়ে দেখে সালেহা শুয়ে রয়েছে। 
----- মা কী হয়েছে তুমি এভাবে শুয়ে রয়েছো কেন??

---- আর বলিস না বাবা, সকাল থেকে কোমর টা যা ব্যাথা করছে!!!

---- কী বলো ডাক্তার ডাকবো আমি???

--- না,না, ডাক্তারের আবার কী দরকার??? একটু ঘুমালেই  ঠিক হয়ে যাবে।

---এটা আবার কেমন কথা ঘুমের সাথে কোমরের কী সম্পর্ক????
--- ও তুই বুঝবিনা।  যা তো আমাকে একটু ঘুমাতে দে।
--- সে তো বুঝলাম কিন্তু সকালের নাস্তা কী আজ তৈরি হবেনা???বুয়া, কদম ভাই এরা কই???
---- ওদের সবার ও কোমর ব্যাথা।
---- কী!!!!!
--- না মানে বাবা, কদমের হাত ব্যাথা  তো তাই সে আসবে না,  আর সকিনার পা ব্যাথা তাই ও আসবেনা।
--- যাক বাবা তোমরা কী সবাই নাজিফার সাথে রোগী হয়ে গিয়েছো???  এখন বাচ্চাদের কী খায়িয়ে স্কুলে পাঠাবো আর তাছাড়া নাজিফার ঔষধ খেতে হলে তো কিছু খেতে হবে।

--- হ্যা তাইতো বাবা না হলে মেয়েটা কিভাবে সুস্থ হবে???  আমি বলি কী তুই তো অনেক ভালো রান্না করতে পারিস,  আগে মানে মিতুর জন্য,  এই আমার জন্য তুই তো কত কিছু অফ ডে তে রান্না করতিস,  তো আজকে না হয়.......

অমনেই ইমাদ চোখ বড় করে তাকাতেই সালেহা আস্তে-- আস্তে বললো --- না মানে আমি নাবা আর নওরীনের কথা ভেবেই বলছি, নাজিফার জন্য কিন্তু বলেনি।  আর তাছাড়া আমি ও কতদিন হয়ে গেলো তোর হাতের খাবার খাইনা।  আগের মতো একটু হাসিখুশী থাকনা বাবা,আগের মতো শখ করে একটু কিছু রান্না করনা।

---- না মা এসব আর আমার দ্বারা হবেনা, যার জন্য করতাম সে তো আমায় ছেড়ে চলে গেছে।  সো আমি পারবোনা।
ইমাদ এই বলে চলে যায়।
সালেহা মুচকি হেসে বললো --- বাবা তোকে যে আজ রান্নাঘরে যেতেই হবে, আফটারঅল আমরা সবাই যে রোগী, হা,হা।



ইমাদ,উপরে গিয়ে নাজিফার সামনে এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করতে লাগলো আর নিজে- নিজেই বকতে লাগলো।।।

--- এ্যা আমাকে রান্না করতে বলছে,  আমি কী মেয়ে নাকি যে রান্না করবো।  যতসব, আমার হয়েছে সব জ্বালা, সবাই রোগী শুধু আমি সুস্থ তাই মেয়েদের মতো এখন আমাকে রান্না করতে হবে। 

এই বলে ইমাদ নাজিফার দিকে চেয়ে রইলো।

--- নাজিফা ভয়ে- ভয়ে ইমাদকে বললো --- আমি কিন্তু কিছু করিনি।  তাহলে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছেন কেন???
----- আপনার জন্যই তো বাড়ির সকলে অসুস্থ।
---- কে আবার অসুস্থ হলো??
--- কে আবার,  আমার মা জানের কোমর ব্যাথা, কদমের হাত ব্যাথা,  বুয়ার পা ব্যাথা।
--- ওমা, এতো ব্যাথা কেন???
--- কারন আজকে ব্যাথা দিবস।
--- সত্যি আজকে ব্যাথা দিবস!!!!! আগে বলবেন না।
এই বলে নাজিফা ইমাদের দিকে তাকাতেই দেখে সাহেব রেগে দানবের মতো হয়ে গেছে,  নাজিফা ইমাদের চেহারার দিকে চেয়ে বললো --- এভাবে তাকাবেন না, ভয় লাগে।
--- চুপ থাকুন।  আমি মরছি জ্বালায় আর আপনি মজা করছেন???



নাজিফা চুপ হয়ে বসে রইলো।  ইমাদ কিছুসময় চুপ থেকে নাজিফাকে বললো --- আমার কী মনে হয় জানেন??? আমার মনে হয় মা এসব ইচ্ছে করে করছে যাতে আমি রান্নাঘরে যাই।  আমি কী মেয়ে যে রান্না ঘরে যাবো রান্না করতে, আজকে সারাদিন সবাই না খেয়ে থাকুক তাতে আমার কী???  ভালো করে আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। 

এই যে আমার বোনটা নিতু এতো বড় হয়েছে অথচ রান্নার র ও পারেনা।  আমার বৌ মনি ওরফে ভাবী,  তেনাকে যদি ভাবী বলি  আরে কী চেঁচামেচি শুরু করে  ভাবী শব্দটা নাকি অনেক গাইয়া  অথচ রান্নাবান্না খেলতে ও পারে কিনা সন্দেহ আছে। আর আমাকে দেখুন, 
আমি পড়াশুনার জন্য যখন বাহিরে ছিলাম, তখন তো ব্যাচেলর ছিলাম, ব্যস নিজের রান্না নিজেই করতাম, রান্না তো মানুষের একটা শখ ও হতে পারে কিন্তু আজকালকার মেয়েরা রান্না করতেই চায়না। 
কিন্তু ওরা বুঝেনা........
ইমাদ চুপ হয়ে গেলে কেননা নাজিফা ওর মুখের ভিতরে কয়েকটা কাগজ ঢুকিয়ে দেয়। 
ইমাদ রেগে গিয়ে বলে --- আপনি এটা কী করলেন???
---- সেই কখন থেকেই কানের সামনে বকবক করেই যাচ্ছেন?  কয়টা বাজে খেয়াল আছে, সাড়ে আটটা আজকে ও কী নাবা, নওরীন স্কুলে যাবেনা।

---- কী!!! সাড়ে আটটা বেজে গেল। 

ইমাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এক দৌড়ে রান্না ঘরে চলে যায়।  নাজিফা বসে-- বসে মুচকি হাসতে থাকে।  আর এদিকে ইমাদ রান্নাঘর গিয়ে রুটি আর ডিম বাজি করে।  নাবা নওরীন, নিতু,সালেহা,সবাই ইমাদকে রান্নাঘরে দেখে অবাক।  সালেহা আড়াল থেকে দাড়িয়ে ইমাদকে রান্নাঘরে দেখে বললো --- বললাম না বাবা আজকে তোকে দিয়েই আমি সকালের নাস্তা বানাবো।
কতদিন পর তুই আবার একটু  রান্না করলি।
নিতু তো নাজিফার উপর রেগে শেষ--- ভাবী মারা যাওয়ার পর ভাইয়া কখনোই রান্নাঘরের সামনে পর্যন্ত আসেনি, অথচ এই মেয়েটির জন্য আজ আবারো ভাইয়া নাস্তা বানাচ্ছে!!!!


নাস্তা বানানো শেষ হতেই ইমাদ নাবা আর নওরীনকে রেডি করে খাবার খায়িয়ে স্কুলে দিয়ে আসে।  স্কুল থেকে বাসায় এসে মাকে নাস্তা দিয়ে নাজিফার কাছে রুটি আর ডিম বাজি নিয়ে যায়। নাজিফা তো ইমাদকে  এই অবস্থায় দেখে পুরোই অবাক।  এতো সুন্দর মনটা  এতোদিন কোথায় লুকিয়েছিলো????  ওর রাগের ভিতরে যে এতো সুন্দর একটা মন আছে তা আমরা কেউই দেখতে পায়নি।
--- এই যে কী ভাবছেন???
--- না কিছুনা। অবশেষে আপনি তাহলে রান্নাঘরে গেলেন??
--- কী করব বলুন রান্নাঘরে না গেলে যে আপনার ঔষধ খাওয়া হতোনা।
--- আমি ঔষধ না খেতে পারলে তাতে আপনার কী????
----- ইমাদ কিছুসময় চুপ থেকে বললো --- আপনি ঔষধ খেতে না পারলে যে আমার  রুম থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবেন না।
---- আসলে কী শুধু এর জন্যই,  আসলে আমি বড্ড বেশি বোকা মেয়ে তাই হয়তো,।
........

---- কী হলো আবার কী ভাবছেন???

---- ভাবছি  আমি সুস্থ হয়ে গেলে শুধু এই রুম থেকে নয় এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।

কথাটি শুনতেই ইমাদের কেমন যেনো খারাপ লাগছিলো। ইমাদ বুঝতে পারছিলো না কেন।  কারন সে তো এটাই চেয়েছিলো  এই মেয়েটি যেনো ওর জীবন থেকে দূরে চলে যায়। তাহলে আজ ও যখন চলে যাওয়ার কথা বলছে তাহলে খারাপ লাগছে কেন।

------ তা এখান থেকে কোথায় যাবেন????
---- গ্রামে?
--- কী মায়ের কাছে?


মা শব্দটি শুনলেই মেয়েটির চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে যায়।  নিয়তির পরিহাসে ছোটবেলায় বাবা মারা যায়, আর মা নিজের আপন হয়ে ও সবসময় সৎ মায়ের মতো আচরণ করেছে।  ভেবেছিলাম জীবনে এমন একটা প্রিয়মানুষ আসবে যার আগমনে আমি আমার সমস্ত  দুঃখ -- কষ্ট ভুলে যাবো।  কিন্তু সবার কপালে সব সুখ  যে আর হয় না  ,  এমন একটা মানুষ জীবনে আসলো যে কীনা.........
নাজিফার চোখে-- মুখে বেদনার সেই নীল রং টা ফুটে উঠে।  অবশ্য উঠবে নাই কেন এমন একটা অমানুষের সাথে বিয়ে হয়েছে যে বিয়ে রাতেই নাজিফা বুঝে ফেলেছি এর সাথে সংসার করা যাবেনা।  কিন্তু লোকনিন্দা থেকে বাঁচতে ২ টা বছর মেয়েটি সমস্ত কষ্ট সহ্য করে সংসার টা  করে । অবশেষে একদিন সত্যিই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। আর পারলোনা,  ডিভোর্স দিতে ই হলো।  কিন্তু মেয়েটি বুঝলোনা আমরা এমন একটা সমাজে থাকি যেখানে একজন মেয়ে স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়া মানে সে এমন কিছু করে ফেলেছে যার জন্য প্রতি- মিনিটে- মিনিটে তাকে  মৃত্যুর স্বাদ টা গ্রহন করতে হবে।  ওর কোনো অধিকারেই নেই ভালো ভাবে বাঁচার, ওর কোনো অধিকারেই নেই অমানুষ কারো সাথে বিয়ে হলে ও তাকে ডিভোর্স দেওয়ার।  আর যদি হয় সে পরহেজগার মেয়ে তাহলে তার পরহেজগারি তা নিয়ে কথা উঠে । পরহেজগার মেয়ে মানে তোমার স্বামী রাতে যদি মদ খেয়ে এসে ও তোমাকে মারে সমাজের মানুষের কথা অনুযায়ী তোমার কাছে সে ব্যাথা অমৃতের মতো লাগতে হবে উহ,আহ ও করতে পারবে না।
নাজিফা টপটপ করে চোখের জল গুলো ছেড়ে দিলো, জীবন যুদ্ধে সে পরীক্ষা দিতে- দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, মাঝে - মাঝে বেলাশেষের সূর্য টা তার হৃদয়ের আকাশে উঠেছে কী না সেটা অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটি খোঁজে,  কিন্তু বেলা যে শেষ হয়না তার তাইতো মাঝি তার ঘাটে এখন ও আসেনি,  বেলাশেষের সূর্য টা ও --- যে এখন ও উঠেনি।


ইমাদ নাজিফাকে এতোক্ষণ অবদি নিশ্চুপ  দেখে ওর কাছে যেতেই দেখে মেয়েটি কাঁদছে।
--- এ কি আপনার চোখে জল কেন??? আপনি কথায় - কথায় এতো কাঁদেন কেন????
--- না এমনি?????
----- তা বললেন না তো কোথায় যাবেন????
----- কোথায় আর যাবো,  দেখি  গ্রামে গিয়ে যদি ভালো কোনো চাকরি পাই তাহলে  একাই থাকবো । 

নাজিফার উওরে ইমাদ একটু হেসে বললো --- তা পড়াশুনা কত দূর করেছেন যে চাকরি  করবেন,  দেখে  তো  মনে হয়না পড়াশুনা করেছেন।

নাজিফা তখন ক্ষীণ কন্ঠে বললো ----অ্যাকাউন্টের উপর বি.বি. এ কমপ্লিট করেছি, তারপর আর পড়াশুনা হয়নি মায়ের কারনে, এটুকু অবদি পড়তেই তো আমাকে...... নাজিফা চুপ হয়ে যায়,

ইমাদের দিকে তাকিয়ে দেখে, ছেলেটি অনিমেষ ভাবে ওর দিকে চেয়ে আছে।
  -
---- এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন???

---- আপনি বি.বি.এ কমপ্লিট করেছেন!!!!

---অবাক হচ্ছেন, আসলে আমাদের মানুষগুলোর সমস্যা কি জানেন?? কেউ যদি রবকে ভালোবাসে তার হুকুম মেনে চলে সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক তার সম্পর্কে আমাদের ধারনা সে অবশ্যই আনস্মার্ট, গাইয়া,,টাইপের ব্যক্তি হবে।  আর জেনারেল পড়াশুনা সেটার সামনে ই যেনো তার যাওয়া উচিত নয়।  অথচ সত্যিকারের যে রবকে ভালোবাসে সে সবচেয়ে স্মার্ট,  শিক্ষিত ও সুশীল ব্যক্তি।সেই মনে করে শুধু দ্বীনি ইলম নয় একজন ব্যক্তি হিসেবে আমাকে সবকিছুর উপর জ্ঞান অর্জন করা উচিত। 



ইমাদ বাকরোধ হয়ে যায়,  আসলেই আমাদের কাছে কোনো ব্যক্তি রবকে ভালোবাসা মানে তার সম্পর্কে আমাদের কোনো ভালো ধারনাই  আসেনা।
ইমাদ মুখে অস্ফুট হাসি ফুটিয়ে নাজিফাকে বললো ------- শুভকামনা, ভালো থাকবেন আর যদি কিছু লাগে তাহলে আমাকে বলবেন।

এই বলে ইমাদ চলে যায়।

নাজিফা ও চলে যেতেই বলে উঠলো
---- এতোকিছু না বলে যদি একবার বলতেন প্লিজ আপনি যেয়েন না,  তাহলে বিশ্বাস করুন আমি পৃথিবীর সব সুখ আজ  পেয়ে যেতাম।  কিন্তু চার অক্ষরের ভালোবাসা শব্দটি হয়তো আমার কপালেই নেই।


দুপুর তিনটে বাজে নাবা আর নওরীন বাড়ি ফিরে আসে,  ইমাদ আজ চেম্বারে যায়নি, সকালে নাজিফার কথাগুলো যেনো তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে কিন্তু কেন এই প্রশ্নটির উওর তার জানা নেই।  ইমাদ আবার ও রান্নাঘরে গেলো ,  নিজেই -- নিজেকে বলতে লাগলো --- ইমাদ যেহুতো মেয়েটি চলে যাবে সেহুতো যে কয়দিন এই বাড়িতে আছে,  মেহমান হিসেবে তুই না হয় তার সেবা কর। 
---- বাবাই- বাবাই তুমি কী কদতো?????
প্রশ্নটি শুনে ইমাদ সামনে তাকাতেই দেখে নাবা,  একটু হেসে বললো --- আমি রান্না করছি মা।
--- কার  দন্য মায়ের দন্য।।।।
---- ইমাদ অবাক হয়ে যায়,  নাবার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে নাবাকে জিজ্ঞাসা করলো--- আচ্ছা মা তুমি ওকে মা বলে ডাক ও কেন???
---- বা দে মাকে মা বদবো না তো কি বদবো?????

( চলবে)
লিখা-- আসমা আক্তার পিংকি।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: